উপরের আলোচনা হইতে দেখিতে পাওয়া গেল যে, লোক-সাহিত্যের? মূলতঃ কোন একজন রচয়িতা থাকিলেও তাহার যেমন কোন ব্যক্তিগত পরিচয় ইহার মধ্য দিয়া প্রকাশ পায় না, তেমনই তাহার সেই মৌলিক (original) রচনারও সাক্ষাংকার লাভ করা যায় না ; সেই রচনা সমষ্টির হাতে পড়িয়া যে নূতন সংস্কার লাভ করে, তাহার সঙ্গেই সকলের পরিচয় স্থাপিত হয়। ইংরেজিতে এই বিষয়টি বড় সুন্দরভাবে প্রকাশ করা হইয়াছে, তাহা সংক্ষেপে এই ভাবে বাংলায় প্রকাশ করা যাইতে পারে। যেমন, লোক-সাহিত্যের কোন বিষয় ব্যক্তিবিশেষ ( individual ) দ্বারা রচিত ( created ) হইবার পর ইহা সমষ্টিগত ভাবে (communally) পুনরায় রচিত (Re-craated) হয়। ইংরেজীতে ইহাকেই communal recreation বলা হইয়াছে। এই পরম তাৎপর্যমূলক ইংরেজি কথা দুইটির অর্থগত উদেশ্য রক্ষা করিয়া ইহাদিগকে যথাযথ ভাবে বাংলায় অনুবাদ করা অসম্ভব, তথাপি ইহা দ্বারা কি মনে করা হইয়াছে, তাহা বুঝিতে কাহারও বেগ পাইতে হইবে না।
লোক-সাহিত্যের যে সম্প্রদায়গত (communal) সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হইল, তাহা হইতে একথা অনুমান করা সঙ্গত হইবে না যে ইহার মধ্যে ব্যক্তি বা ব্যষ্টি (Individual) র কোন পরিচয়ই নাই, ইহা কেবল মাত্র সামগ্রিক সমাজ-চৈতন্যরই বাহন। একজন পাশ্চাত্য সমালোচক এই সম্পর্কে বলিয়াছেন যে, লোকসাহিত্য ‘is something which the individual has in common with his fellows, just as all have eyes and hands and speech. It is not contrary to himself as an individual but a part of his equipment. It makes possible—perhaps it might be defined as that which constitutes—his rapport with his particular segment of mankind.’
[M. Harmon, SDFML, p. 400.]
অর্থাৎ যে সকল বিষয় বা বস্তুর অথিকারী হইবার জন্য এ্কই সমাজভুক্ত একজন অন্যজন হইতে অভিন্ন, লোক-সাহিত্য তাহাদের অন্যতম । ইহা যেন আমাদের চক্ষু, হস্ত ও ভাষার মত; এই সকল বিষয় আছে বলিয়াই আমরা প্রত্যেকে মানুষ বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকি; লোক-সাহিত্যও তাহাই। ব্যষ্টি-জীবনের বিরোধী ইহাতে কিছু নাই, বরং ইহা তাহার জীবনের একটি অঙ্গ। ইহা দ্বারা ব্যক্তিবিশেষ মানব-সমাজের বিশিষ্ট একটি অংশের সঙ্গে নিজের যে একটি সম্পর্ক আছে, তাহা অনুভব করিয়া থাকে। সমাজের সঙ্গে লোক-সাহিত্যের সম্পর্ক বিষয়ে এই উক্তিগুলি বিশেষ ভাবে ভাবিয়া দেখিবার মত।
উপরে লোক-সাহিত্যের যে সংজ্ঞাটি লইয়া এতক্ষণ আলোচনা করিলাম, তাহার একটি অংশ সম্বন্ধে আরও দুই একটি কথা বক্তব্য আছে। লোকসাহিত্য যে ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে উদ্ভুত হইয়াও সমষ্টির সৃষ্টি বলিয়া উল্লেখ করিয়াছি, সেই সম্পর্কে সকলেই একমত নহেন। কেহ কেহ মনে করেন, যেহেতু ইহার কোন একজন রচয়িতার সুম্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় না, সুতরাং ইহা ‘collective creation of the folk’ অর্থাৎ সাধারন কর্তৃক সমষ্টিগত ভাবে সৃষ্ট। কোন লোক-সঙ্গীত, গীতিকা কিংবা কথা যে মূলতঃ একজনের সৃষ্টি না হইয়া কি ভাবে সমষ্টির সৃষ্টি হইতে পারে, তাহা সহজে অনুমান করিতে পারা যায় না। তথাপি মনে করা হয় যে, সংহত সমাজের মধ্যে প্রত্যেক সামাজিক অনুষ্ঠানই দলগত ভাবে (communally) পালন করা হয়। সামাজিক কোন সমবেত নৃত্যানুষ্ঠানে একজন হয়ত সঙ্গীতের একটি পদ রচনা করিয়া গাহিল, তাহা শুনিবা মাত্র সেই নর্তক গোষ্ঠীর মধ্যেই আর একজন আর একটি পদ রচনা করিল, এইভাবে প্রায় সকলের সহায়তায়ই ইহা একটি পরিপূর্ণ সঙ্গীতের রূপ লাভ করিল। সেই নৃত্যানুষ্ঠানে সঙ্গীতটি বার বার গীত হইবার ফলে তাহা সকলেরই প্রায় কণ্ঠস্থ হইয়া গেল—রচনার দিক দিয়া যদি ইহা কোন প্রকার বৈশিষ্ট্য লাভ করিতে পারে, তবে তাহাদের মুখ হইতেই ইহা সহজেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রচার লাভ করে। এই পদ্ধতির রচনাকে ব্যক্তিবিশেষের রচনা বলা যায় না, সমষ্টিগত রচনাই বলিতে হয়। কেহ কেহ এই ভাবেই সমগ্র লোক-সাহিত্যের উদ্ভব হইয়াছে বলিয়া অনুমান করিয়া থাকেন। ফরাসী সমাজতত্ত্ববিদ ডার্খেম এই মতের পক্ষপাতী। তিনি ‘psychology of crowds' <বা জনতার মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন। যদিও ফরাসী সমাজতত্ত্ববিদগণের মধ্যে লোক-সাহিত্যের উদ্ভব সম্পর্কে এই মত কতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছে, তথাপি পাশ্চাত্ত্যের অন্যান্য যে সকল অঞ্চলে লোক-সাহিত্যের ব্যাপকতর গবেষণা হইতেছে, সেই সকল অঞ্চলে এই মত আজ পর্যন্ত ও বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারে নাই।
উক্ত মতবাদ সম্পর্কে একটি প্রধান আপত্তি এই হইতে পারে যে, নাতিদীর্ঘ গীতি বা গান এই উপায়ে রচিত হওয়া সম্ভব হইলেও, দীর্ঘতর কথা (folk-tale), গীতিকা (ballad) বা আখ্যায়িকাগীতি (narrative song) এই উপায়ে রচিত হওয়া সম্ভব নহে। কারণ, আনুপূর্বিক সুবিন্যস্ত একটি কাহিনী নৃত্যপর কোন জনতা (crowd) কতৃক রচিত হইতে পারে না ; ইহার সঙ্গতি, ও একটি সুম্পষ্ট পরিণতি নির্দেশ করিবার জন্য রচয়িতার ধৈর্য ও সংসম অবলম্বন করিয়া বিষয়টি সম্পর্কে চিন্তা করিবার প্রয়োজন হয়। অতএব পূর্বোল্লিখিত ডক্টর ভেরিয়র এলউইন যে বলিয়াছেন, "gifted individuals do arise in the peasant communities' অর্থাৎ কৃষক-সমাজের মধ্যেও প্রতিভাবান ব্যক্তিবিশেষের প্রকৃতই যে আবির্ভাব হয়, তাহা সত্য। এই সকল gifted individual’ দ্বারাই অন্তত: লোকসাহিত্যের দীর্ঘতর বিষয়গুলি যে সর্বপ্রথম পরিকল্পিত হইয়া থাকে, তাহা কেহই অস্বীকার করিতে পারিবেন না। যদি তাহাই হয়, তবে ইহার ক্ষুদ্রাকৃতি সঙ্গীতগুলিও যে কেন এই প্রকার ‘প্রতিভাবান ব্যক্তিবিশেষ’ দ্বারা প্রথম রচিত হইতে পারিবে না, তাহাও বুঝিতে পারা যায় না। অতএব দেখা যাইতেছে, ফরাসী সমাজতত্ত্ববিদ ডার্খেমের মতবাদ নির্ভরযোগ্য যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নহে। কেহ কেহ এই মতবাদকে ‘sentimental’ বা কেবল মাত্র হৃদয়াবেগের উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়াও নিন্দা করিয়াছেন। কিন্তু ডার্খেম কোমতের মতই পাশ্চাত্ত্য সমাজবিদ্যায় এক নূতন যুগের স্রষ্টা, কেবল মাত্র হৃদয়াবেগ তাঁহার অবলম্বন হইলে তিনি পাশ্চাত্ত্য চিন্তাধারায় বিপ্লব আনিতে পারিতেন না ; অতএব মনে হয়, তাহার উক্তি আংশিক সত্য বলিয়াও গৃহীত হইতে পারে; কারণ, ক্ষুত্রাকৃতি লোক-সঙ্গীত রচনায় তিনি যে পদ্ধতিটির কথা উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা কোন সময় সমাজের কোন এক স্তরে প্রচলিত থাকিবার পক্ষে কোন বাধা ছিল বলিয়া মনে হয় না। কিন্তু দীর্ঘতর রচনায় এই রীতি কোনদিন প্রচলিত ছিল বলিয়া নে হইতে পারে না।
[ বাংলার লোকসাহিত্য: খন্ড-১, আশুতোষ ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা নং: ১২-১৪]
Post a Comment