কেবল আমাদের দেশেই নহে, সকল দেশেই এমন সন্দেহবাদী লোক আছেন, তাহারা মনে করেন যে, গায়েন (traditional singer) ই লোকসঙ্গীতের উদ্ভাবক ('make it up himself’ )। ইহার উত্তরে বলা যাইতে পারে যে, পল্লীর ব্যবসায়ী গায়েনগণ যে ইহাতে কোন কোন অংশ সংযোগ ও বিয়োগ করিয়া থাকে, তাহা সত্য; কিন্তু তাহা দ্বারাই ইহার বৃহত্তর আবেদন লুপ্ত হইয়া যায় না। কারণ, গায়েন যদি প্রকৃতই ব্যবসায়ী হয়, তাহা হইলে তাহাকে লোকের রুচির দিকে লক্ষ্য রাখিতেই হইবে এবং সেই দিকে লক্ষ্য রাখিয়া ইহার কোন অংশ পরিবর্তিত কিংবা নূতন সংযোজিত হইলে, তাহা দ্বারা লোক-সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য লুপ্ত হইবে না। এমন কি, আনুপূর্বিক নূতন কোন বিষয়ও যদি গায়েন বিশিষ্ট কোন সংহত সমাজের রুচির প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া রচনা করিতে পারে, তবে তাহাও কালক্রমে লোক-সাহিত্যের অন্তভূক্ত হইয়া পড়িবে। এই ভাবেই লোক-সাহিত্যের পুষ্ট হইয়াছে, ইহা কেবল মাত্র ইহার সনাতন পুঁজির উপর নির্ভর করিয়া পুষ্ট লাভ করিতে পারে না। কিন্তু সমাজের রস ও রুচির উপর ভিত্তি করিয়া যদি ইহা রচিত না হয়, তবে ইহা একদিনের জন্যও কেহ ধৈর্য ধরিয়া শুনিবে না, সঙ্গে সঙ্গেই ইহার অপমৃত্যু হইবে।
অতএব গায়েন কিংবা অন্য যে কেহই যদি ইহা সমসাময়িক কালে রচনাও করে, তাহা হইলেও কেবল মাত্র ইহার বৈশিষ্ট্যগুলি যদি ইহাতে বর্তমান থাকে, তবে তাহা লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হইতে কোন বাধা হইতে পারে না। সমসাময়িক বিষয়-বস্তু অবলম্বন করিয়া রচিত গীতিকা সমসাময়িক কালে রচিত হইয়াও এবং জনশ্রুতিমূলক কোন বিষয়-বস্তু অবলম্বন না করিয়াও লোক-সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। পল্লীর সহস্ৰ সহস্ৰ শ্রোতা এই সকল কাহিনী শুনিয়া আনন্দ ও বেদনা লাভ করিয়াছে। তবে ইহাদের প্রকৃতি স্বতন্ত্র।
অতএব গায়েন কিংবা অন্য যে কেহই যদি ইহা সমসাময়িক কালে রচনাও করে, তাহা হইলেও কেবল মাত্র ইহার বৈশিষ্ট্যগুলি যদি ইহাতে বর্তমান থাকে, তবে তাহা লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হইতে কোন বাধা হইতে পারে না। সমসাময়িক বিষয়-বস্তু অবলম্বন করিয়া রচিত গীতিকা সমসাময়িক কালে রচিত হইয়াও এবং জনশ্রুতিমূলক কোন বিষয়-বস্তু অবলম্বন না করিয়াও লোক-সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। পল্লীর সহস্ৰ সহস্ৰ শ্রোতা এই সকল কাহিনী শুনিয়া আনন্দ ও বেদনা লাভ করিয়াছে। তবে ইহাদের প্রকৃতি স্বতন্ত্র।
লোক-সাহিত্যের অধিকাংশ বিষয়ই সমসাময়িক কোন সমাজ কিংবা ব্যক্তি কর্তৃক উদ্ভাবিত ও রচিত হওয়া অসম্ভব। কারণ সমাজের মধ্যে লোক-সাহিত্য বিকাশ লাভ ( develops) করিতে দেখা যায়, জন্মলাভ করিতে দেখা যায় না। ইহা ব্যক্তি বা সমাজ-চক্ষুর অগোচরেই জন্মলাভ করে, তারপর সমাজের মধ্য দিয়া ক্রমবিকাশ লাভ করিতে থাকে। যেহেতু ইহার রচয়িতা রূপে কোন ব্যক্তিবিশেষের সন্ধান পাওয়া যায় না, সেইজন্য ইহার উদ্ভবের প্রকৃত প্রণালী যে কী, সেই সম্পর্কেও কোন জ্ঞান লাভ করা যাইতে পারে না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ লোক-কথা ( folk-tale )র উল্লেখ করা যাইতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, কল্পনার দৌড় থাকিলেই লোক-কথা বিশেষতঃ রূপকথা রচনা করা যাইতে পারে। কিন্তু এই কথা আদৌ সত্য নহে। আমরা শ্রুতি-পরম্পরায় যে লোক-কথার সঙ্গে পরিচয় লাভ করিয়া থাকি, তাহার এমনই একটি রস ও ভঙ্গি আছে যে, তাহা ইচ্ছা করিলেই কেহ রচনা করিতে পারিবে না। এই সম্পর্কে যাহা প্রয়োজন, তাহা ‘faculty of mythic invention’ অর্থাৎ প্রাচীন বা পৌরাণিক বিষয় উদ্ভাবনের শক্তি ; কিন্তু আধুনিক যুগে সেই faculty বা শক্তি আমাদের মধ্যে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। ইহার যে একটি বিশিষ্ট প্রকাশ-ভঙ্গি আছে, তাহা আমরা শুনিতেই অভ্যস্ত, কিন্তু রচনা করিতে অভ্যস্ত নহি ; অতএব সেই শক্তিও আমাদের নাই। অতি আধুনিক সাহিত্যে রূপকের স্থান সংকীর্ণ, অথচ এই রূপকই লোক-সাহিত্যের জগৎ অনেকখানি অধিকার করিয়া রাখিয়াছে। সুতরাং বর্তমান পরিবেশের মধ্যে বাস করিয়া আমরা সত্য-কল্পনা-রূপকে মিশ্রিত লোক-সাহিত্যের জগৎ যথার্থ রূপায়িত করিতে পারি না।
লোক-সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ধারায় নূতন নূতন বিষয়ও যুক্ত হইতেছে বলিয়া মনে হয় ; কিন্তু গভীর ভাবে বিচার করিয়া দেখিলে বুঝিতে পারা যায় যে, ইহাদের মধ্যে নূতন কিছুই নাই। যাহা নূতন বলিয়া মনে হয়, তাহা সমাজের পরিবেশ কিংবা অন্তস্তলে বর্তমান ছিল, তাহা সেখান হইতেই গ্রহণ করিয়া ব্যবহার করা হইয়াছে মাত্র; প্রয়োজন মত তাহা পরিবর্তনও করা হইয়াছে, তারপর সমাজের মধ্যে নূতন রূপে তাহা প্রচারিত হইয়াছে-- প্রচারিত হইবার পর যথাযথ বিবেচনা করিলে সমাজ ইহা রক্ষা করিয়াছে, অন্যথায় পরিত্যাগ করিয়াছে। ব্যক্তি-প্রতিভার প্রেরণায় অভিনব উপাদান দ্বারা যে কেহই লোক-সাহিত্যের সৃষ্টি করিতে পারে না, তাহাই এখানে , বক্তব্য বিষয়। সমাজের সমস্ত দেহ ও মন যখন একটি ভাবে পূর্ণ হইয়া উঠে, তখন সমষ্টির ভিতর দিয়াই তাহার বাণীরূপ প্রকাশ পায়, তবে অনেক সময় ব্যষ্টি ইহার উপলক্ষ্য হয় মাত্র।
একটি প্রশ্ন এখানে আলোচনা করিতে পারা যায় যে, আধুনিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিংবা নাগরিক জীবনে লোক-সাহিত্যের স্থান কি? বিষয়টি একটু গভীরভাবে বিবেচনা করিলেই দেখিতে পাওয়া যাইবে যে, লোক-সাহিত্য চিরন্তন মানবিক বৃত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়াই রচিত হয়। রচনার বহিরঙ্গগত গঠন আধুনিক সমাজের বিচারে যতই স্থূল হউক না কেন, ইহার অন্তর্নিহিত ভাবের একটি সর্বজনীন আবেদন থাকে। বিশেষতঃ ইহার ভিতর দিয়া চিরন্তন সামাজিক নীতি ও ধর্মের জয় ঘোষিত হয়। চিরন্তন মানবিক দুর্বলতা সমূহও ইহাদের ভিতর দিয়া কৌশলে প্রকাশ করা হয়। বিজয় বসস্তের প্রতি তাহাদের বিমাতার যে বিদ্বেষের কথা বাংলা লোক-সাহিত্যে শুনিতে পাওয়া যায়, তাহা এক চিরন্তন মানবিক বৃত্তির উপর নির্ভর করিয়া রচিত হইয়াছে। সেইজন্য ইহা দেশ কালোত্তীর্ণ হইতে পারিয়াছে। ইহারই ভাবটি একটি স্বতন্ত্র পরিবেশের মধ্য দিয়া ইউরোপীয় লোক-সাহিত্যে রচিত সিণ্ডেরেলা (Cinderella)র কাহিনীর ভিতর দিয়াও প্রকাশ পাইয়াছে। একটি চিরন্তন মানবিক বৃত্তি আশ্রয় করিয়াছে বলিয়াই সিণ্ডেরেলার রূপকথা সকল দেশের অধিবাসীকেই মুগ্ধ করিতে পারে। সাহিত্যের বিষয় চিরন্তন— তাহা লোক-সাহিত্যেরই হউক, কিংবা উচ্চতর সাহিত্যেরই হউক ; এই চিরন্তনতার গুণেই সাহিত্য কালজয়ী ; অতএব লোক-সাহিত্য সর্বদাই সকল শ্রেণীর পাঠকেরই প্রিয় হইতে পারে। আধুনিক যুগে উপন্যাস পাঠ করিয়া আমরা যে আনন্দ লাভ করিয়া থাকি, লোক-সাহিত্যেও অনেক ক্ষেত্রেই সেই আনন্দের বীজ নিহিত থাকে। তবে উভয়ের প্রকাশ-ভঙ্গির মধ্যে যে পার্থক্য আছে, কেবল মাত্র তাহা দ্বারাই ইহাদের মধ্যে পার্থক্য বোধ সৃষ্টি হয়, গভীরভাবে অনুধাবন না করিলে ইহাদের অন্তর্নিহিত ঐক্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। লোক-সাহিত্যের কোন কোন বিষয় রূপক সংকেত বা ইজ্ঞিতের ভিতর দিয়াও প্রকাশ পাইয়া থাকে। রূপক বা “the mythical story with its symbols has an element of permanency for it brings before us, under a veil, the predicaments, the joys and the sorrows of human life; we begin to see why it is that folk-tales, these humble sisters of written art, still have power to stir our interest and even our feelings.’*
* R. M. Dawkins, “Some Remarks on Greek Folk-tales', Folk-Lore, LIX (1948), p. 68.
যাহা চিরন্তন মানবিক বৃত্তির উপর ভিত্তি করিয়া রচিত, ব্যক্তি-মানসেই হউক, কিংবা সমাজ-মানসেই হউক, তাহার আবেদন ব্যর্থ হইতে পারে না। অতএব আত্মকেন্দ্রিক আধুনিক নাগরিক জীবনে লোক-সাহিত্যের কোন সমাদর হইবে না এমন কথা বলিতে পারা যায় না।
তবে একটি কথা এখানে ভুলিলে চলিবে না। নাগরিক মন উচ্চতর সাহিত্য হইতেই রসপিপাসা চরিতার্থ করিতে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে। উচ্চতর সাহিত্যের প্রকাশ-ভঙ্গি এবং লোক-সাহিত্যের প্রকাশ-ভঙ্গি এক নহে। যদিও লোক-সাহিত্যের মধ্যে একটি চিরন্তন আবেদন আছে সত্য, তথাপি সেই আবেদনটির বহিরঙ্গগত রূপ ক্রমে নাগরিক সমাজের মধ্যে অপরিচিত হইয়া উঠিতেছে। সেইজন্য রূপকথা কিংবা উপকথার মধ্যে যে শাশ্বত আবেদনই থাকুক না কেন, তাহা আধুনিক সাহিত্য হইতে রস-সংগ্ৰহ করিতে অভ্যস্ত পাঠকের নিকট কোনও কৌতুহল সৃষ্টি করিতে পারে না। কিন্তু আধুনিক রুচি ও রসবোধ অনুযায়ী লোক-সাহিত্যের বিশ্লেষণ করিয়া এই বিষয়ে কৌতুহল সৃষ্টি করিতে পারিলে ইহার প্রতি অনুরাগ সঞ্চার হওয়া সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলে ভুলানো ছড়া’ আলোচনাটি আধুনিক মনের নিকট এই জন্যই আকর্ষণীয় হইয়াছে।
যুগের রুচির উপর নির্ভর করিয়া লিখিত সাহিত্যের বহির্জগত রূপ চিরদিনই পরিবর্তিত হইতেছে, সমসাময়িক সমাজের নিকট সমসাময়িক প্রচলিত রূপটিই আবেদন সৃষ্টি করিতে সক্ষম হয়, কিন্তু লোক-সাহিত্যের রূপ বহুলাংশে রক্ষণশীল, ইহার বিষয়-বস্তুর মধ্যে স্থানে স্থানে যে পরিবর্তনই স্বীকৃত হউক না কেন, ইহার বহিরঙ্গরূপ সহজে পরিবর্তিত হয় না ; সেইজন্য লিখিত সাহিত্য পাঠে অভ্যস্ত নাগরিক শিক্ষিত সমাজের নিকট লোক-সাহিত্য প্রত্যক্ষভাবে সহজে আবেদন সৃষ্টি করিতে পারে না।
[তথ্যসূত্র : বাংলার লোক-সাহিত্য: খন্ড-১, আশুতোষ ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠ নং: ৮-১২]
Post a Comment