লোক-সাহিত্যের সংজ্ঞা নির্দেশ করিতে গিয়া একটি বিষয়ের উপর যে কেহ কেহ অতিরিক্ত জোর দিয়া থাকেন, তাহার কথা এখন উল্লেখ করিব। লোক-সাহিত্যের সংজ্ঞা নির্দেশ করিতে গিয়া কেহ কেহ সাধারণভাবে বলিয়াছেন যে ‘unwritten literature of any group, whether having writing or being without it.’ -M.J Herskovits SDFML p.400  অর্থাৎ ইহা কোন সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর অলিখিত সাহিত্য—এই সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মধ্যে লেখার ব্যবহার প্রচলিত থাকিতেও পারে, নাও থাকিতে পারে। এই সংজ্ঞানুযায়ী অলিখিত সাহিত্য মাত্রই লোক-সাহিত্য। ইংরেজিতে ইহাকেই oral literature বলা হয়। 
  এই সম্পর্কে আরও একজন সমালোচক আরও একটু সামান্য বিস্তৃতভাবে বলিয়াছেন যে, ইহা ‘embraces those literary and intellectual phases of culture which are perpetuated primarily by oral tradition: myths, tales, folk-song, and other forms of oral' traditional literature.’ - G. Hersog, ibid. অর্থাৎ জাতীয় সংস্কৃতির যে সকল সাহিত্যিক ও মননশীল সৃষ্টি মুখ্যতঃ মৌখিক ধারা অনুসরণ করিয়া অগ্রসর হইয়া যায়, তাহাই লোক-সাহিত্য। যেমন গীতিকা, কথা, সঙ্গীত ইত্যাদি।
লোকসাহিত্যের এই সংজ্ঞাই যদি গ্রহণ-যোগ্য বলিয়া মনে হয়, তবে এই সম্পর্কে স্বভাবতঃই একটি কথা মনে হইতে পারে যে, ষে ভাবেই ইহার উদ্ভব হউক না কেন, সমাজের মধ্যে ইহা যে রূপে প্রচার লাভ করে, সেই রূপেই যদি ইহাকে লিখিত হইতে পারা যায়, তবে তাহার লোক বৈশিষ্ট্য (folk-characteristic) বিনষ্ট হইয়া যায় কি না।
  লোক-সাহিত্যের সংজ্ঞা সম্পর্কে এ পর্যন্ত যে আলোচনা করিলাম, তাহা হইতে নিশ্চয়ই এই কথাটি স্পষ্ট হইয়াছে যে, লোক-সাহিত্য কেহ লিখিয়া রচনা করিতে পারেনা; যখন ইহার উদ্ভব হয়, তখন ইহা মুখে মুখেই রচিত হয় এবং প্রথম অবস্থায় ইহা মুখে মুখেই প্রচারিত হয়। কিন্তু বহু সমাজেই যখন লেখার এখন ব্যাপক প্রচার হইয়াছে, তখন ইহা লিখিয়া লইবার পথও রোধ করিতে পারা যায় না। প্রকৃত পক্ষে পূর্ববর্তী কালে সমাজ যখন সম্পূর্ণ নিরক্ষর ছিল, তখন সকল দেশেই স্মৃতিশক্তির যে রকম অনুশীলন হইত, আজ আর কোথাও তেমন হয় না। সেইজন্যই একদিন যাহা স্মৃতির উপর নির্ভর করিয়াই চলিয়া আসিয়াছিল, আজ তাহাই লিখিত হইয়া সমাজের স্মৃতির ভার লাঘব করিতেছে। লোক-সাহিত্যের উপরোক্ত সংজ্ঞা স্বীকার করিয়া লইলে ইহা এই অবস্থার সম্মুখীন হইয়া অর্থাৎ লিখিত হইলে ইহার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লুপ্ত হইয়া যাইবে কি না, তাহা আলোচনা করিয়া দেখা প্রয়োজন।
  এই সম্পর্কে একজন পাশ্চাত্ত্য সমালোচক বলিয়াছেন যে, ইহা লিখিত হইতে আপত্তি নাই, কিন্তু তাহা অভিজ্ঞ বা বিশেষ ভাবে শিক্ষিত গবেষক (“trained investigators’) কর্তৃক লিখিত (“committed to writing’) হওয়া চাই। অনভিজ্ঞ বা অসতর্ক লেখক কর্তৃক লিখিত হইলে ইহা বিকৃত হইবার আশঙ্কা আছে। কিন্তু এখানে একটি কথা উল্লেখ করিতে পারা যায়। বহিরাগত কোন গবেষক যদি স্বতন্ত্র কোন জাতির লোকসাহিত্য সংগ্ৰহ করিতে চাহেন, তবে তাহা সংগ্ৰহ করিবার যে বিশেষ শিক্ষা তাহার প্রয়োজন, কেহ যদি নিজস্ব লোক-সাহিত্য সংগ্ৰহ করিতে চাহেন, তবে তাহার সেই বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন নাও হইতে পারে। কারণ, ইহার খুটিনাটি সম্পর্কে তাহার যে স্বাভাবিক জ্ঞান থাকিবে, তাহা হইতেই তাহা নিখুঁতভাবে লিখিত হইতে পারে। তবে তাহার পক্ষেও লিখিবার সময় তাহার ব্যক্তিগত বিশিষ্ট রস-বোধ, বিচার-বুদ্ধি ও সকল প্রকার সৃজনী প্রেরণা সংযত রাখা অবশ্যক। এ’কথা সত্য, তিনি যাহা লিখিয়া লইবেন, তাহা প্রচলিত লোক-সাহিত্যের বিশেষ অার একটি রূপ (version) হইবে। কিন্তু তথাপি যেহেতু তিনি সেই সমাজেরই অন্তর্ভুক্ত এবং সেই সমাজের বিশিষ্ট প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত, সেইজন্য তাঁহার লিখিত রূপ প্রচলিত রূপের বিশেষ ব্যতিক্রম হইবে না—যতটুকু একজনের মুখ হইতে আর একজনের মুখে প্রচারিত হইতে গেলেও হইয়া থাকে, ততটুকুই হইতে পারে মাত্র ; অতএব তাহা একেবারে অগ্রাহ বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে না।
  বাংলাদেশের লোক-সাহিত্য সংগ্রহ ও প্রকাশের ইতিহাস হইতে এখানে একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত দিতে পারি। স্বপ্রসিদ্ধ ‘মৈমনসিংহ-গীতিকার সংগ্রাহক স্বর্গত চন্দ্রকুমার দে মৈমনসিংহ জিলার যে অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন, সেই অঞ্চলেই গীতিকাগুলি প্রচলিত ছিল। তিনি গীতিকাগুলি যে ভাবে শুনিয়াছিলেন, সেই ভাবেই সংগ্ৰহ করিয়াছেন—ইহাদের ভাব, ভাষা, ভঙ্গি সবই তাহার নিজের নিকট সুপরিচিত ছিল ; সেইজন্য যাহা শুনিয়াছেন, তাহা লিখিয়া লইবার পক্ষে তাহার কোন অন্তরায় হয় নাই ; কিংবা তিনি যাহা লিখিয়া লইয়াছিলেন, তাহাও ইহাদের প্রচলিত রূপ হইতে বিশেষ কোন ব্যতিক্রম ছিল না। গীতিকাগুলি এইভাবে গায়কের মুখ হইতে লিখিয়া লইয়া স্বর্গত দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের নিকট তিনি প্রেরণ করিতেন।
  স্বৰ্গত সেন মহাশয় বাংলাদেশের এক স্বতন্ত্র অঞ্চলের অধিবাসী এবং ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র প্রকৃতি ও রূপ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলেন ; অনেক স্থলে তিনি ইহাদের ভাষার অর্থও যে বুঝিতে পারেন নাই, তাহা তাহার লিখিত ভাষা-টীকা হইতেও জানিতে পারা যায়। লোক-সাহিত্যের প্রতি তাহার স্বগভীর অনুরাগ ও সহানুভূতি থাকিলেও, তিনি যে এই বিষয়ে ‘trained investigator’ ছিলেন. তাহা বলিতে পারা যায় না। বর্তমানে যে বিজ্ঞান-সন্মত উপায়ে পাশ্চাত্ত্য দেশে লোক-সাহিত্যের সম্পাদন হইয়া থাকে, তাহার সঙ্গেও তাহার পরিচয় ছিল না। তিনি এই বিষয়ে পাশ্চাত্য কোন অভিজ্ঞ গবেষকের সহায়তা বা পরামর্শ ব্যতীতই ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’ নিজের মতে সম্পাদন করিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এখানে বক্তব্য এই যে, স্বৰ্গত চন্দ্রকুমার দে যে ভাবে গীতিকাগুলি সংগ্ৰহ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন, সেই ভাবেই সেগুলি প্রকাশিত করিয়া দিলে, কিংবা কোন “trained investigator'এর সহায়তায় তাহা সম্পাদন করিয়া প্রকাশিত করিলে ইহাদের যে মূল্য প্রকাশ পাইত, স্বর্গীয় দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের মধ্যস্থতায় তাহা প্রকাশিত হওয়ায় তাহাদের সেই মূল্য প্রকাশ পায় নাই। এই বিষয়ে স্বৰ্গত চন্দ্রকুমার দে’র যে অধিকার ছিল, স্বৰ্গত দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের সেই অধিকার ছিল না ; অথচ তিনিই এই ভার নিজের উপর গ্রহণ করিয়া নিজের ইচ্ছামত ইহাদিগকে এক একটি ভর রূপ দিয়া প্রকাশিত করিয়াছেন। ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’র মধ্যে যদি কোন কৃত্রিমতা প্রকাশ পাইয়া থাকে, তবে ইহার এই ক্রটির জন্যই তাহা প্রকাশ পাইয়াছে, অন্য কোন কারণের জন্য নহে।
  অতএব একটি কথা এখানে স্পষ্ট হইল যে, লোক-সাহিত্য লিথিয়া লইতে কোন বাধা নাই ; কিন্তু তাহার লেখক স্বতন্ত্র সমাজের অন্তভূক্ত হইলে এই বিষয়ে তাহার বিশেষ শিক্ষা থাকার প্রয়োজন ; আর যদি তিনি সেই সমাজেরই লোক হন, তবে তাহার বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন নাও হইতে পারে ; কিন্তু এই ক্ষেত্রে তাহাকে নিজের রস-বিচার ও সৃজনী প্রতিভা সংযত রাখিতে হইবে--যাহা যাহা শুনিলাম, তাহাই যথাযথ লিখিতে হইবে, যাহা বুঝিলাম তাহা নহে। সেইজন্য বর্তমানে লোক-সাহিত্য সংগ্রহ ব্যাপারে পাশ্চাত্ত্য গবেষকগণ সর্বদা শব্দগ্রাহক যন্ত্র ব্যবহার করিয়া থাকেন—তাহাতে সঙ্গীত ও বাদ্য যথাযথ গৃহীত হয়, পরে গবেষণাগারে বসিয়া সেই অনুযায়ী তাহা পুনলিখিত হইয়া থাকে। অতএব লেখা ও সম্পাদনার ভিতর দিয়া লোক-সাহিত্য যে রূপান্তরিত হইবার আশঙ্কা আছে, তাহার বিরুদ্ধে সকলেই সকল প্রকার সতর্কতা অবলম্বন করিয়া থাকেন। তাহা সত্বেও সমাজ হইতে নিরক্ষরতা দূর হইবার সঙ্গে সঙ্গে লোক-সাহিত্য সকল দেশেই লিখিত হইয়াছে এবং লেখার ভিতর দিয়াও ইহার প্রচার হইয়াছে। সকল দেশেই ইহার লিখিত পাণ্ডুলিপি ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ইহা যথাযথ ভাবে লিখিত হইলে ইহার অপকার অপেক্ষা উপকারই বেশি হয়, ইহাতে ইহার লোক-বৈশিষ্ট্য হ্রাস পায় না। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদিগের অভিমত এই যে, '
“The transference of oral tradition to writing and print does not destroy its validity as folklore but rather while freezing or fixing its form, helps to keep it alive and to diffuse it among those to whom it is not native or fundamental. For the folk-memory forgets as much as it transmits and improves. In the reciprocity of oral and written tradition and the flux of cultural change and exchange, revival plays as important a part as survival, popularization is as essential as scholarship, and the final responsibility rests upon the accumulative and collective taste and judgment of the many rather than the few.”--
B. A. Botkin, ibid, p. 899,

  উদ্ধৃত অংশে কতকগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-সম্পর্কে সমালোচক কয়েকটি নূতন কথা বলিয়াছেন। প্রথমতঃ যাহা মুখে মুখে চলিয়া আসিতেছে, তাহা লিখিত কিংবা মুদ্রিত হইলেই যে লোক-শ্রুতি (folklore) হিসাবে ইহার মূল্য হ্রাস পায়, তাহা নহে ; বরং তাহা দ্বারা তাহার একটি বিশিষ্ট রূপ স্বনির্দিষ্ট হইয়া যায়, অর্থাৎ মুখে মুখে ইহা কেবলই যে পরিবর্তিত হইতে হইতে অগ্রসর হইত, লিখিত হইবার ফলে তাহার সেই পথ রুদ্ধ হইয়া যায়। তখন লিখিত রূপটি আদর্শ হইয়া দাঁড়ায় এবং তাহা ভিত্তি করিয়াই ইহা সর্বত্র প্রচার লাভ করে। বাংলার লোক-সাহিত্য হইতে ইহার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে। 
  সমগ্র বাংলা ও আসামে মনসা-মঙ্গল কাহিনীর কোন ব্যতিক্রম নাই, দুই এক স্থানে সামান্য যে এক-আধটু ব্যতিক্রম দেখা যায়, তাহাও মূল কাহিনীর ব্যতিক্রম নহে, ইহার বহিরঙ্গগত ব্যতিক্রম মাত্র ; কিন্তু তাহাও নিতান্ত উপেক্ষণীয়। এই বিস্তৃত অঞ্চল ব্যাপিয়া ইহার কাহিনীগত এই ঐক্য রক্ষা পাইবার একমাত্র কারণ, লিখিত পুথি অবলম্বন করিয়াই ইহার প্রচার হইয়াছে, কেবল মাত্র মৌখিক আবৃত্তি অবলম্বন করিয়া ইহার প্রচার হয় নাই। ইংলণ্ডেও যতদিন পর্যন্ত Robin Hood Ballad মুখে মুখে প্রচারিত হইত, ততদিন পর্যন্ত এক এক অঞ্চলে ইহার এক এক রূপ প্রকাশ পাইয়াছে ; কিন্তু ইহা লিখিত ও মুদ্রিত হইয়া প্রচারিত হইবার পর, ইহার ক্রমপরিবর্তনের ধারা রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে, বরং তাহার পরিবর্তে ইহার আখ্যানগত একটি সামগ্রিক ঐক্য গড়িয়া উঠিয়াছে। লোক-সাহিত্যের এই স্বাভাবিক ক্রমপরিবর্তনের ধারা লুপ্ত হইয়া যাইবার ফলে কতক যে ক্ষতিও হইয়াছে, তাহাও একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। ইহার প্রধান ক্ষতি এই হইয়াছে যে, মৌখিক আবৃত্তির ভিতর দিয়া প্রচারিত হইলে ইহা যে কখনও কোনও প্রতিভাবান গায়কের মুখে পড়িয়া উন্নততর হইতে পারিত, ইহার সেই ভবিষ্যৎ একেবারে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে ; অবশ্য এই ক্ষতি আর এক দিক দিয়া পূরণও হইয়াছে; কারণ, মৌখিক প্রচারের ফলে অনেক সময় যে ইহার বিকৃত (degenerated ) হইবার সম্ভাবনা থাকে, ইহা লিখিত হইলে ইহার সেই সম্ভাবনা লুপ্ত হইয়া যায় বিশেষতঃ সমাজে প্রতিভাবান লোকের সংখ্যা কম এবং সাধারণ লোকের সংখ্যাই বেশি; সুতরাং সাধারণের হাতে পড়িয়া ইহার বিকৃত হইবার সম্ভাবনাই অধিক। অতএব এই দিক দিয়া বিবেচনা করিলে লোক-সাহিত্য লিখিত হইবার ফলে ইহার কোন উন্নতির আর আশা না থাকিলেও, ইহার অধোগতিও রুদ্ধ হইয়া যায়। কিন্তু এই বিষয়ে আর একটি কথা আছে—লোকসাহিত্যের কোন লিখিত রূপ সমাজে প্রচলিত না থাকিলে ইহার প্রত্যেক গায়কই ইহার মধ্যে কিছু না কিছু অংশ নিজে যোগ করিয়া লইবার স্বাধীনতা গ্রহণ করিতে পারে। প্রচলিত সঙ্গীত গাহিবার সঙ্গে সঙ্গে গায়ক নিজেও কিছু সৃষ্টি করিবার প্রেরণা লাভ করে এবং তাহা হইতে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু সৃষ্টি করিয়া ইহাতে প্রতিনিয়তই যোগ করিয়া থাকে। ইহাতে সমাজে ব্যষ্টিমনের সৃজনী শক্তির অনুশীলন অব্যাহত থাকিতে পারে। কিন্তু লোক-সাহিত্যের কোনও লিখিত রূপ যদি সমাজের আদর্শ হইয়া দাঁড়ায়, তবে ব্যক্তিমনের এই শক্তি (individual initiative) বিনষ্ট হয়; তাহার ফলে ক্রমে লোক-সাহিত্য হইতে ব্যক্তিমনের সকল ঔৎসুক্য দূর হইয়া যাইবার আশঙ্কা থাকে। বর্তমানে লোকসাহিত্যের জনপ্রিয়তার অভাবের ইহাও অন্যতম কারণ বলিয়া নির্দেশ করিতে পারা যায়।
  লোক-সাহিত্যের প্রধান ধর্মই এই যে, ইহা সজীব,—ইহার ধারা ক্রমপরিবর্তনের ভিতর দিয়া অগ্রসর হইতে থাকে, মৌখিক আবৃত্তি ও পরিবর্তনের ভিতর দিয়া ইহার জীবনী-শক্তি রক্ষা পায়—কোন নির্দিষ্ট আদর্শের বদ্ধকুণ্ডে যদি ইহা গিয়া রুদ্ধ হইয়া পড়ে, তবে অচিরেই ইহার প্রাণ-শক্তি লুপ্ত হইয়া যায়।... “a folk-song evolves gradually as it passes through the minds of different men and different generations.’ অর্থাৎ ব্যক্তি ও বংশপরম্পরায় লোক-সঙ্গীত ক্ৰমবিকাশ লাভ করে; কিন্তু ইহার কোন একটি বিশিষ্ট রূপ একান্ত আদর্শ হইয়া পড়িলে ইহার এই ক্রমবিকাশের ধারা বাধা প্রাপ্ত হয়; ক্রমবিকাশের ভিতর দিয়া জীবনী-শক্তি রক্ষা যাহার ধর্ম, তাহার সেই পথই যদি রুদ্ধ হইয়া যায়, তবে তাহার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হইতেও অধিক বিলম্ব থাকিতে পারে না।
  কেহ কেহ এমন কথা বলিয়াছেন যে, লোক-সাহিত্য লিখিত হইলে তাহা নূতন নূতন ক্ষেত্রে প্রচারিত (diffused) হইবার পক্ষে সুবিধা হয়।কিন্তু পূর্বে ষে আলোচনা করিয়াছি, তাহা হইতে বুঝিতে পারা যাইবে যে, এক সমাজের লোক-সাহিত্য সেই সমাজেরই নিজস্ব বা স্বকীয় সৃষ্টি, সেই সমাজের অন্তর্ভুক্ত নরনারীই তাহার প্রকৃত রসবেত্তা, নূতন ক্ষেত্র বা স্বতন্ত্র সমাজে গিয়া তাহা প্রচার লাভ করিতে পারে না। বিশেষতঃ কাগজে কলমে লোক-সাহিত্যের বিষয় কতটুকু লিখিয়া লইতে পারা যায়? এই বিষয়ে একজন স্বপ্রসিদ্ধ সমাজতত্ত্ববিদের একটি উক্তি এখানে উদ্ধৃত না করিয়া পারিতেছি না। তিনি লিখিয়াছিলেন, “The stories live in native life and not on paper, and when a scholar jots them down without being able to evoke the atmosphere in which they flourish he has given us but a mutilated bit of reality,” -- B.Malinowski, Magic, Science and Religion and other(London, 1949) p.82. 
সমাজ-জীবনে যাহা অন্তর্নিবিষ্ট হইয়া আছে, কাগজে কলমে তাহার কতটুকু পরিচয় প্রকাশ করা যাইতে পারে? অতএব যতটুকুই আমি লিখিয়া লই না কেন, তাহার ভিতর দিয়া আমি লোক-সাহিত্যের প্রকৃত রসের শতাংশের একাংশও পরিবেষণ করিতে পারিব না। যে উপায়ে লোক-সাহিত্য প্রচারিত হইয়া থাকে, তাহার যথাযথ বর্ণনার ভিতর দিয়া ইহার সম্বন্ধে প্রকৃত ঔৎসুক্য জাগ্রত করা যাইতে পারে। এখানে কেবল লিখিত কিংবা মুদ্রিত পুস্তক পড়িয়া কিংবা তাহা আবৃত্তি করিয়াই ইহার রস উপলদ্ধি করা যাইবে না। “The whole nature of the performance, the vice and the mimicry, the stimulus and the response of the audience mean as much to the natives as to the text.”
  লোক-সাহিত্যের কোন লিখিত রূপের ভিতর দিয়া তাহার প্রকৃত রস কিছুতেই ফুটাইয়া তুলিতে পারা যায় না। ‘মৈমনসিংহ-গীতিকার’ যে কথাগুলি ছাপার অক্ষরে আমাদের চোখের সম্মুখে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করিবার স্পর্ধা লইয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা বাংলার সুদুর উত্তর-পূর্ব প্রান্তবর্তী অঞ্চলের কতটুকু রূপ ও রস নিজেদের মধ্যে লইয়া আসিয়াছে? উন্মুক্ত আকাশের নীচে স্তিমিত মশালের আলোকে সহস্ৰ সহস্র পল্লীর নিরক্ষর শ্ৰোতা নগ্নগাত্রে কটিবাস মাত্র পরিধান ও তৃণাসন মাত্র সম্বল করিয়া গায়েনের মুখ হইতে যে মহুয়ার দুঃখের কাহিনী শুনিয়া নীরবে অশ্রপাত করিতেছে, তাহা যে তাহাদেরও বেদনায় রঞ্জিত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা প্রাণহীন ছাপার অক্ষরগুলি কেমন করিয়া প্রকাশ করিবে? লোক-সাহিত্য প্রাণ দিয়া যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনই প্রাণ ঢালিয়াই প্রচারও হয়। গায়েনের চোখে জন্ম দেখিয়া শ্রোতার চোখে জল গড়াইয়া পড়ে, শ্রোতার চোখে জল দেখিয়া গায়েনের চক্ষু সিক্ত হইয়া উঠে। এই অশ্রু দুঃখেরও যেমন হয়, আনন্দেরও তেমনি হইতে পারে।হৃদয় অধিকার করিবার শক্তিই লোক-সাহিত্যের শক্তি এই শক্তি কাগজে কলমে কি করিয়া প্রকাশ পাইবে? অতএব লোকসাহিত্যের লিখিত কোন রূপের ভিতর দিয়া ইহার যথার্থ পরিচয় প্রকাশ পায় না; সুতরাং ইহার সাহায্যে ইহার নূতন নূতন ক্ষেত্রে প্রচার-লাভেরও কোন সহায়তা হইতে পারে না।
  উত্তর ব্রহ্ম অঞ্চল হইতে যে লোক-কথা (folk-tale) সংগ্রহ প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে বাংলাদেশে প্রচলিত বহু লোক-কথা স্থান পাইয়াছে। বাংলাদেশ হইতে যদি তাহা উত্তর ব্রহ্ম অঞ্চলে প্রচারিত হইয়া থাকে, তবে তাহা কোন দিনই যে তাহার কোন লিখিত রূপ অর্থাৎ হস্তলিখিত কিংবা মুদ্রিত পুস্তকের ভিতর দিয়া প্রচার লাভ করে নাই, তাহা সত্য। বাংলাদেশের সঙ্গে মণিপুর কিংবা আরাকানের ভিতর দিয়া উত্তর ব্রহ্মের যে যোগ স্থাপিত হইয়াছিল, সেই সূত্রে তাহা বাংলাদেশ হইতে একদিন মুখে মুখেই সেখানে প্রচার লাভ করিয়াছিল। তেমনই সাঁওতাল পরগণার বহু উপকথা বাংলাদেশেও শুনিতে পাওয়া যায়, তাহাও যে একদিন এক অঞ্চল হইতে অন্য অঞ্চলে মৌখিক প্রচার লাভ করিয়াছিল, তাহাও সহজেই বুঝিতে পারা যায়। এমন কি, খ্ৰীষ্ট জন্মের পূর্ব হইতেই বহু ভারতীয় উপকথা যে ইউরোপ মহাদেশে প্রচার লাভ করিয়াছিল, তাহাও কোনও লিখিত রূপের ভিতর দিয়া প্রচার লাভ করে নাই—মৌখিকই প্রচার লাভ করিয়াছিল। সাহিত্যের মৌখিক রূপের যে প্রাণ-শক্তি (Vitality) আছে, তাহার লিখিত রূপের তাহা নাই।

[তথ্যসূত্য: বাংলার লোকসাহিত্য: খন্ড-১, আশুতোষ ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা নং: ১৫-২২]