লোক-সাহিত্য কাহাকে বলে? এই বিষয়ে কেবল মাত্র আমাদের দেশের কেন, পাশ্চাত্ত্য সমালোচকদিগের মধ্যেও যে একটি সুস্পষ্ট ধারণা প্রচলিত আছে, এমন কথা বলিতে পারা যায় না। তবে ইহার সম্বন্ধে একটি বিষয়ে পাশ্চাত্ত্য সকল সমালোচকই প্রায় একমত হইয়া থাকেন যে, ইহা সংহত সমাজের সামগ্রিক সৃষ্টি, ব্যক্তিবিশেষের একক সৃষ্টি নহে। উচ্চতর সাহিত্যের সঙ্গে এইখানেই ইহার মূল পার্থক্য। বিষয়টি একটু গভীর ভাবে এখানে বিচার করিয়া দেখা প্রয়োজন।
সংহত সমাজ বলিতে এখানে যে সমাজ ইহার অন্তভূক্ত মানব গোষ্ঠীর পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিতর দিয়া চিরাচরিত প্রথায় নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অটুট রাখিয়া চলে, তাহাই মনে করা হইয়াছে ; কিন্তু যে সমাজ কেবল মাত্র নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া চলে, তাহা মনে করা হয় নাই । বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য কথা দুইটিতে একটু পার্থক্য আছে। যে সমাজ বাহির হইতে নিত্য নূতন উপাদান গ্রহণ করিয়া তাহা নিজের সমাজের উপযোগী করিয়া লইতে পারে, সেই সমাজ আপাতদৃষ্টিতে বাহিরের দিক দিয়া পরিবর্তিত বলিয়া মনে হইলেও, প্রকৃত অন্তরের দিক দিয়া অপরিবর্তিতই থাকিয়া যায়;
কারণ, এখানে একটি কথা বলিয়াছি যে, বহিরাগত উপকরণ সমূহ যে নিজের সমাজের উপযোগী করিয়া লইতে পারে ; এই নিজের সমাজের উপযোগী করিয়া লওয়ার মধ্যেই ইহার স্বকীয়তা রক্ষা পায়। কিন্তু যে সমাজ নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া চলে, সে বহিরাগত সাংস্কৃতিক উপকরণ নিজের মধ্যে কোন ভাবেই গ্রহণ না করিয়া কেবলই পরিত্যাগ করিয়া যায়। সাংস্কৃতিক উপকরণ সমূহই সামাজিক সংহতি সৃষ্টির মূল। যে সমাজের সাংস্কৃতিক উপকরণ যত বেশি, তাহার সামাজিক সংগতিও তত দৃঢ়। অতএব যে সমাজ বাহির হইতে কিছুই গ্রহণ করে না, সর্ববিষয়ে কেবলই পুরুষানুক্রমিক পুঁজির উপরই নির্ভর করিয়া চলে, তাহার পুঁজি শেষ হইতেও বেশি বিলম্ব হয় না বলিয়াই তাহার বিনাশের পথ প্রশস্ত হইয়া থাকে। এইভাবে বহু স্বতন্ত্র বা বিচ্ছিন্ন (isolated) সমাজ পৃথিবীর পৃষ্ঠ হইতে একেবারে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। কিন্তু যে সমাজ বিভিন্ন ক্ষেত্র হইতে সাংস্কৃতিক উপকরণসংগ্ৰহ করিয়া তাহানিজের উপযোগী করিয়া লইতে লইতে অগ্রসর হইয়া যায়, তাহার স্বকীয়তাও যেমন একদিক দিয়া রক্ষা পায়, তেমনই প্রাণশক্তিরও কোনদিন অভাব হয় না। স্বতন্ত্র সমাজকে আদিম (primitive) সমাজ বলা যায় ; কিন্তু লোক-সাহিত্য যে সমাজের সৃষ্টি, তাহা আদিম সমাজ নহে, তাহা হইতে আরও অগ্রসর সমাজ ; কারণ, তাহার মধ্যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থাকিলেও তাহা বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপকরণে সমৃদ্ধ। বিষয়টি এইবার দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইলে আরও একটু স্পষ্ট হইতে পারে।
কারণ, এখানে একটি কথা বলিয়াছি যে, বহিরাগত উপকরণ সমূহ যে নিজের সমাজের উপযোগী করিয়া লইতে পারে ; এই নিজের সমাজের উপযোগী করিয়া লওয়ার মধ্যেই ইহার স্বকীয়তা রক্ষা পায়। কিন্তু যে সমাজ নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া চলে, সে বহিরাগত সাংস্কৃতিক উপকরণ নিজের মধ্যে কোন ভাবেই গ্রহণ না করিয়া কেবলই পরিত্যাগ করিয়া যায়। সাংস্কৃতিক উপকরণ সমূহই সামাজিক সংহতি সৃষ্টির মূল। যে সমাজের সাংস্কৃতিক উপকরণ যত বেশি, তাহার সামাজিক সংগতিও তত দৃঢ়। অতএব যে সমাজ বাহির হইতে কিছুই গ্রহণ করে না, সর্ববিষয়ে কেবলই পুরুষানুক্রমিক পুঁজির উপরই নির্ভর করিয়া চলে, তাহার পুঁজি শেষ হইতেও বেশি বিলম্ব হয় না বলিয়াই তাহার বিনাশের পথ প্রশস্ত হইয়া থাকে। এইভাবে বহু স্বতন্ত্র বা বিচ্ছিন্ন (isolated) সমাজ পৃথিবীর পৃষ্ঠ হইতে একেবারে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। কিন্তু যে সমাজ বিভিন্ন ক্ষেত্র হইতে সাংস্কৃতিক উপকরণসংগ্ৰহ করিয়া তাহানিজের উপযোগী করিয়া লইতে লইতে অগ্রসর হইয়া যায়, তাহার স্বকীয়তাও যেমন একদিক দিয়া রক্ষা পায়, তেমনই প্রাণশক্তিরও কোনদিন অভাব হয় না। স্বতন্ত্র সমাজকে আদিম (primitive) সমাজ বলা যায় ; কিন্তু লোক-সাহিত্য যে সমাজের সৃষ্টি, তাহা আদিম সমাজ নহে, তাহা হইতে আরও অগ্রসর সমাজ ; কারণ, তাহার মধ্যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থাকিলেও তাহা বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপকরণে সমৃদ্ধ। বিষয়টি এইবার দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইলে আরও একটু স্পষ্ট হইতে পারে।
আসামের অধিবাসী মণিপুরী ও নাগা মূলতঃ একই সমাজ বা জাতির (race) দুইটি বিভিন্ন আঞ্চলিক (territorial) শাখা। ইহাদের মধ্যে নাগা-সমাজকে প্রকৃত স্বতন্ত্র বা বিচ্ছিন্ন (isolated) সমাজ বলা যায় ; কারণ, ইহা নিজের পুরুষানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য নিচ্ছিদ্র রাখিয়া সকল প্রকার প্রতিবেশীর সংস্রব বাঁচাইয়া চলিতে চলিতে আজ ধ্বংসের সম্মুখীন হইয়াছে। ইহা নিজেরও যেমন কিছু পরিত্যাগ করে নাই, তেমনই অন্যেরও কিছু গ্রহণ করে নাই। এখানে খ্ৰীষ্টীয়ান নাগাদিগের কথা বলিতেছি না, আদিম নাগাদিগের কথাই বলিতেছি। অাদিম নাগাদিগের মধ্যে পৃথিবীর বর্বরতম একটি সামাজিক প্রথা আজিও প্রচলিত আছে, তাহা নরমুণ্ড শিকার (head-hunting)। কিন্তু তাহারই অন্যতম আঞ্চলিক শাখা মণিপুরীদিগের ইতিহাস স্বতন্ত্র। যে কোন কারণেই হউক, একদিন নাগাজাতির মূল শাখা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়া একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ইহা একটি বিশিষ্ট সামাজিক জীবন গড়িয়া তুলিয়াছিল। এই সামাজিক জীবনের একটি প্রধান ধর্ম এই ছিল যে, ইহা নিজের মধ্যে নিশ্ছিদ্র হইয়া বাস করে নাই ; যে সকল উপকরণ দ্বারা সমাজের স্বাস্থ্য পুষ্ট ও আয়ু বর্ধিত হইতে পারে, তাহা ইহা নিজের মধ্যে গ্রহণ করিয়াছে—তাহার ফলে ইহার প্রাণশক্তি ও অঙ্গ সৌষ্ঠব দুই-ই বৃদ্ধি পাইয়াছে; কিন্তু ইহার আকৃতি ও প্রকৃতির মৌলিক কোন পরিবর্তন হয় নাই। মণিপুর একদা ব্ৰহ্মদেশের অধীন ছিল ; সেই সময় ইহা ব্রহ্মদেশীয় সাংস্কৃতিক উপকরণ নিজের মধ্যে গ্রহণ করিয়াছে তারপর সংহত সমাজ ও লোক-সাহিত্য একদিন যখন বাংলাদেশ হইতে বৈষ্ণবধর্ম গিয়া সেখানে প্রচার লাভ করিয়াছিল, সেইদিনও সে তাহার সমাজ-জীবনের মধ্যে তাহা বরণ করিয়া লইয়াছে ; কিন্তু ধর্মপালনের তাহার যে নিজস্ব আঙ্গিক, তাহাই ইহার উপর আরোপ করিয়া লইয়াছে। এইখানেই মণিপুর অন্যের উপকরণ গ্রহণ করিয়াও স্বকীয়তা রক্ষা করিয়াছে। ব্রহ্মদেশ কিংবা বাংলার সংস্কৃতি ইহার সংস্কৃতি গ্রাস করিতে পারে নাই, বরং উভয়ের নিকট হইতে দুই হাত পাতিয়া ইহা যাহা গ্রহণ করিয়াছে, তাহা সে নিজের মত করিয়া লইয়াই ব্যবহার করিয়াছে ; ইহাদের মধ্যে সব চাইতে বড় কথা এই যে, ইহাদের চাপে পড়িয়া সে তাহার নিজস্ব সংস্কৃতির মৌলিক প্রকৃতি বিসর্জন দেয় নাই। সেইজন্য মণিপুরবাসিগণ অর্জুনের বংশধর বলিয়া দাবী করিলেও মহাভারতের সংস্কৃতির মধ্যেই আচ্ছন্ন হইয়া নাই, উৎসবে পার্বণে তাহারা নিজেদের জাতীয় চরিত্রসমূহের মহিমা কীর্তন করিয়া থাকে ; রাধাকৃষ্ণের প্রেম-কাহিনী অপেক্ষাও মণিপুরে থৈবী ও খাম্বার প্রেম-কাহিনী অধিকতর জনপ্রিয়। সঙ্গীতে ও নৃত্যে একদিক দিয়া ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনী যেমন তাহারা নিজেদের মত করিয়া রূপায়িত করিতেছে, আবার তেমনই নিজেদের জাতীয় আখ্যায়িকা সমূহকেও তাহাদের মধ্য দিয়া রূপ দিতেছে। অতএব মণিপুরীর সমাজ একটি আদর্শ সংহত সমাজ, অর্থাৎ ইহাই যথার্থ লোক-সংস্কৃতি (folk-culture) তথা লোক-সাহিত্যের জন্মস্থান হইতে পারে। কিন্তু নাগার সমাজ আদিম (primitive) সমাজ, ইহার মধ্যে লোকসাহিত্যের সৃষ্টি হইতে পারে না ; যাহা হয়, তাহা অপরিণত ও অসম্পূর্ণ— সাহিত্যের কোন পরিচয় তাহাতে প্রকাশ পায় না। এই শ্রেণীর বহু আদিম সমাজের মধ্যে জনশ্রুতিমূলক (traditional) কোন সাহিত্যের অস্তিত্বই নাই। কিন্তু আদিম জাতির সমাজ যে সংহত নহে, তাহা নহে ; তথাপি যে বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপকরণের সমাবেশে লোক-সাহিত্য বিকাশ লাভ করিতে পারে, তাহা তাহার মধ্যে নাই ; সেইজন্য প্রকৃত লোক-সাহিত্য বলিতে যাহা বুঝায়, তাহা নাগাদিগের মধ্যে নাই, মণিপুরীদিগের মধ্যে আছে।
সংহত সমাজের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহাতে ব্যষ্টি (individual): র কোন দাবী স্বীকৃতি হয় না, সমষ্টির বা সামগ্রিক (communal) দাবীই সেখানে স্বীকৃত হয়। ব্যক্তিবিশেষ সেখানে কিছুই নহে, সমষ্টির জন্যই তাহার অস্তিত্ব। সেই জন্য তাহাতে পরস্পর পরস্পরের আপেক্ষিক এবং সমগ্রভাবে সকলে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে আবদ্ধ। বিষয়টি একটু গভীরভাবে বুঝিবার প্রয়োজন আছে। কারণ, দেখিতে পাওয়া যাইবে ষে, লোক-সাহিত্যের বিশিষ্ট একজন কোন রচয়িতার প্রায়ই সন্ধান পাওয়া যায় না। ইহার মূল ইহার সামাজিক অবস্থার মধ্যেই নিহিত থাকে ; কারণ, যে সমাজ ব্যক্তির কোন অধিকার কিংবা প্রতিষ্ঠা স্বীকার করে না, তাহার নিকট বিশিষ্ট একজন কবি কিংবা গীতি-রচয়িতার কোন স্থান নাই, বরং তাহার পরিবর্তে সমগ্র সমাজই ইহাদের রচয়িতা বলিয়া বিবেচনা করা হয়—সে’কথা পরে আরও বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইবে। সংহত সমাজের মধ্যে ব্যক্তি বা ব্যষ্টির যে কোন অধিকার কিংবা প্রতিষ্ঠা স্বীকৃত হয় না, এখানে সে’কথাই বলিতেছি। ইংরেজিতে এই স্তরের সমাজ-জীবনকে community life বলে। ইহাতে সমাজের জন্য ব্যক্তি, ব্যক্তির জন্য সমাজ নহে। গ্রামে যখন কোন অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ কিংবা মড়ক দেখা দেয়, তখন গ্রামের অধিবাসিগণ সমগ্র গ্রামের অধিষ্ঠাতা গ্রাম্য দেবতার নিকট সমবেতভাবে ইহার প্রতিকারের জন্য প্রার্থনা জানায়। গ্রাম্য দেবতা ব্যক্তিবিশেষের দেবতা নহেন, ব্যক্তিবিশেষের সুখদুঃখে তিনি উদাসীন, কিন্তু তাহা হইলেও সমগ্র গ্রামের কল্যাণ-সাধনে তিনি সর্বদা তৎপর; সমগ্রভাবে গ্রামের পক্ষ হইতে তাঁহার নির্দিষ্ট পূজার যদি কোন ব্যাঘাত হয়, তাহা হইলে তিনি সমস্ত গ্রামের উপর দিয়াই তাহার প্রতিহিংসা গ্রহণ করেন, ব্যক্তিবিশেষের উপর দিয়া নহে। এই প্রকার সমাজভুক্ত কোন ব্যক্তিবিশেষ (individual) যদি কোন অসামাজিক আচরণ, যথা বিধিনিষেধ (taboo) লঙ্ঘন ইত্যাদি করে, তবে সমগ্র সমাজকেই তাহার শাস্তি ভোগ করিতে হয় বলিয়া মনে করা হয়। অতএব যেখানে সমগ্র সমাজের দেহে ব্যক্তির জীবন এমন অন্তনিবিষ্ট হইয়া আছে এবং ব্যক্তির কোন স্বাধীন সত্তা নাই, সেই সমাজের সাহিত্যের প্রকৃতিও যে ব্যক্তি-কেন্দ্রিক সমাজের সাহিত্য হইতে স্বতন্ত্র হইবে, তাহা বলাই বাহুল্য।
আধুনিক উচ্চতর সাহিত্য ব্যক্তি-প্রতিভা দ্বারা সৃষ্ট ; ইহার মধ্যে সমাজচেতনা যাহাই থাকুক না কেন, তাহা ইহার রচয়িতার মানসলোকে যে ভাবে প্রতিভাত হয়, তাহার উপর ভিত্তি করিয়াই রূপায়িত হয়। নাটকপ্রমুখ নৈর্ব্যক্তিক (impersonal) সাহিত্যের মধ্যেও রচয়িতার ব্যক্তিগত শিল্পপ্রতিভার স্পর্শ এত স্বম্পষ্ট হইয়া উঠে ষে, তাহাও কিছুতেই সমগ্র সমাজের সৃষ্টি বলিয়া মনে হইতে পারে না। কিন্তু প্রকৃত সংহত সমাজের মধ্য হইতে ব্যক্তিবিশেষও যদি কিছু রচনা করে, তবে তাহাতে সমগ্র সমাজেরই প্রাণ স্পদিত হইয়া থাকে। যেখানে ব্যক্তি-জীবনের কোন স্বতন্ত্র মূল্য নাই, সেখানে ব্যক্তি-প্রতিভার আত্ম-কেন্দ্রিক সাধনাও নাই; সেইজন্য ইহার রচনা সহজেই সমগ্র সমাজের রচনা বলিয়াই গৃহীত হইতে পারে।
সংহত সমাজ কথাটি বুঝাইতে এত কথা বলিতে হইল। লোক-সাহিত্যের যে সংজ্ঞাটি লইয়া আলোচনা করিয়াছি, তাহার আরও একটি অংশ বুঝিতে বাকি আছে ; তাহা এই যে, ইহা সামগ্রিক সৃষ্টি, ব্যক্তিবিশেষের একক সৃষ্টি নহে। এই বিষয়ে সকলেই যে সম্পূর্ণ একমত তাহা নহে ; কারণ, কেহ মনে করেন,‘ All aspects of folklore, probably originally the products of individuals, are taken by the folk and put through a process of recreation, which through constant variation and repetition become a group product’. *
[* Mao Edward Leach, Standard Dictionary of Folklore, Mythology and Legend [SDFML] ed. Maria Leach (New York, 1949-59). p. 401. ]
অর্থাৎ লোকশ্রুতির সকল বিষয়ই মূলতঃ ব্যক্তিবিশেষেরই সৃষ্টি, তারপর সম্ভবতঃ সেই ব্যক্তির নিকট হইতে জনসাধারণ তাহা গ্রহণ করে এবং তাহা ক্রমাগত নূতন করিয়া পুনর্গঠন করিতে থাকে— এইভাবে ক্রমাগত পরিবর্তন ও পুনরাবৃত্তির ভিতর দিয়া তাহা পরিণামে একটি সামগ্রিক সৃষ্টির রূপ লাভ করে।
এখানে সমালোচক বলিতে চাহেন যে, লোক-সাহিত্য মূলতঃ ব্যক্তিবিশেষ বা এক জনেরই সৃষ্টি, তবে সৃষ্টি মাত্র তাহা দশজনের হাতে গিয়া পড়ে এবং তখন দশজন তাহাদের নিজেদের মত করিয়া তাহা নূতন ভাবে গড়িয়া লয় ; তখন তাহার যে রূপ প্রকাশ পায়, তাহা সমষ্টিরই সৃষ্টি, ব্যষ্টির নহে। কিন্তু এখানে কথা হইতেছে, দশজনের হাত হইতেই ইহা সমাজের মধ্যে প্রচার লাভ করিতেছে, একজনের হাত হইতে নহে ; অতএব ইহার একজন রচয়িত মূলতঃ ইহা যে ভাবে রচনা করিয়াছিল, তাহা আমাদের দৃষ্টির অগোচরেই থাকিয়া যায়। সমাজের মধ্যে যখন তাহা প্রচার লাভ করে, তখন তাহা দশজনের সৃষ্টি হইয়া পড়িয়াছে, একজনের সৃষ্টি আর নাই। অতএব লোক-সাহিত্য আমরা যে রূপে লোকমুখ হইতে সংগ্ৰহ করিয়া থাকি, তাহা সমষ্টিরই সৃষ্টি, ব্যষ্টির সৃষ্টি নহে৷ লোক-সাহিত্যের এই অংশই সাহিত্য সংজ্ঞালাভের অধিকারী। ব্যক্তিবিশেষের মনে যে ভাবটির উদয় হয়, তাহার প্রকাশ অপরিণত ও অপরিস্ফুট থাকিবারই কথা, ইহা দশজনের হাতে পড়িয়াই প্রকৃত সাহিত্যের রূপ লাভ করিয়া থাকে। অতএব ব্যষ্টির মনে যে সকল অপরিণত ভাবের উদয় হয়, তাহাই সমষ্টি লোক-সাহিত্যের রূপে সমাজকে পরিবেশন করে। অতএব লোক-সাহিত্যের বহিরঙ্গগত পরিচয়ের জন্য সমষ্টির দান স্বীকার করিয়া লইলেও, ইহার অন্তর্নিহিত ভাব-মূলে যে ব্যষ্টির প্রেরণাই কার্যকরী হইয়া থাকে, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। অতএব লোক-সাহিত্য ব্যষ্টি ও সমষ্টির সমবেত সৃষ্টি; ব্যষ্টির মনে যে ভাবের উদয় হয়, তাহার অসম্পূর্ণ রূপায়ণকেই সমষ্টি নিজের আদর্শে সম্পূর্ণ করিয়া লয়। এই প্রসঙ্গে একজন বিশেষজ্ঞের একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করিতেছি—
‘It is often said that there is no such thing as a village poet or a village folk-lorist, that the tales and songs of the people are very old and owe little or nothing to modern individual effort. My own experience leads me to doubt this. It is true that a great many of the songs are the possessions of the people as a whole ; nobody knows when they are composed, they are repeated again and again and the only change is often a change for the worse. But at the same time gifted individuals do arise in the peasant communities. Even these do not regard their poems and songs as copyright. They compose them in the excitement and rapture of the dance and before they know what has happened, they have become public treasure. A man sings his beatitude in the excitement of a love-affair and soon every youth and maiden in the countryside is making love in the same words.’
[Verrier Eiwin Folk-songs of Ohattisgarh (Bombay, 1646). Introduction, P. L.]
ইহার মধ্যে একটি কথা আমাদের পূর্ব-গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরোধী, সেই কথাটিই এখানে বিচার করিয়া দেখিতে হইবে। এখানে বলা হইয়াছে যে, দশজনের হাতে পড়িয়া ব্যক্তিবিশেষের রচনা যে পরিবর্তিত হইতে থাকে, তাহার ফলে ইহা ক্রমাগতই নিকৃষ্ট (Change for the worse) হইতে থাকে অর্থাৎ ক্রমোন্নতি (evolution)র পরিবর্তে ক্রমাবনতি (degeneration)- বাদকেই এখানে স্বীকার করা হইয়াছে। কিন্তু এই মতবাদ স্বীকার করিয়া লওয়া যায় না ; কারণ, ক্রমাবনতির পরিণামই হইতেছে বিলুপ্তি ( extinction ) । অতএব ক্রমাবনতির ধারা অনুসরণ করিয়া অগ্রসর হইতে থাকিলে, ইহা কালক্রমে একেবারেই লুপ্ত হইয়া যাইত—এই ভাবে বহু দেশের লোক-সাহিত্যই লুপ্ত হইয়া যাইবার কথা ছিল। অতএব ক্রমাবনতির পথ না ধরিয়া ক্রমোন্নতির পথে অগ্রসর হইয়াছে বলিয়াই ইহা পৃথিবীর প্রত্যেক অংশেই কেবল মাত্র যে আত্মরক্ষা করিয়া আছে, তাহাই নহে—বরং অগণিত সমাজের কোটি কোটি অধিবাসীর আনন্দ-দানে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিতেছে। ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’র এই দুইটি পদ,—
কোথায় পাইবাম কলসী, কন্যা, কোথায় পাইবাম দড়ি।
তুমি হও গহীন গাঙ্গ আমি ডুব্যা মরি।।
লোক-সাহিত্যের ক্রমাবনতির কোনও ‘ফল হইতে পারে না, বরং ইহা ক্রমোন্নতির চরম নিদর্শন। অতএব দেখা যাইতেছে যে, ব্যক্তিবিশেষের অপরিণত রচনা সমষ্টির হাতে পড়িয়া অনেক সময় উন্নতি লাভ করে, সর্বদাই অধোগতি লাভ করে না। ক্রমোন্নতির পথেও নানা বহিমুখী সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণে যেমন ইহার বাধা আসিয়া যাইতে পারে, তেমনই ইহার ক্রমাবনতির পথও সহসা রুদ্ধ হইয়া গিয়া তাহা বিপরীতমুখী হইয়া উঠিতে পারে, অর্থাৎ অবনতি রুদ্ধ হইয়া গিয়া ইহা উন্নতির পথও ধরিতে পারে। বহির্মুখী সামগ্রিক সমাজ-জীবনের অবস্থার উপরই ইহার উন্নতি এবং অবনতি নির্ভর করে।
[তথ্যসূত্র : বাংলার লোক-সাহিত্য: খন্ড-১, আশুতোষ ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা নং : ১-৭]
Post a Comment