লোক-সাহিত্যকে অনেকেই অত্যন্ত প্রাচীন মনে করিয়া ইহার মধ্যে প্রাচীন সমাজের চিত্র অনুসন্ধান করিয়া থাকেন। স্বৰ্গত দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় খৃষ্টীয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রংপুরের কৃষকদিগের মুখ হইতে সংগৃহীত ‘গোপীচাঁদের সন্ন্যাস’ বা ‘ময়নামতীর গান' নামক গীতিকা (ballad য় বাংলার খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর সমাজ-চিত্রের সন্ধান পাইয়াছেন বলিয়া দাবী করিয়াছেন; কারণ, তিনি মনে করিয়াছেন, যেহেতু উক্ত কাব্যের নায়ক গোপীচন্দ্র খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন বলিয়া জানিতে পারা যায়, সেইজন্য উক্ত গীতিকাও খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতেই রচিত হইয়াছিল। বিশেষজ্ঞদিগের মধ্যে কেহ মনে করেন যে, লোক-সাহিত্যকে যেমন সর্বাংশে প্রাচীন বলিয়া দাবী করা যায় না, তেমনই একান্ত আধুনিক বলিয়া দাবী করাও সঙ্গত হয় না—it is like a forest tree with its roots deeply buried in the past but which continually puts forth new branches, new leaves, new fruits.’ -- R. V. Williams `folk-song’ Encyclopaedia Britannica, Fourteenth Edition (1982) (EB) 9. 448.
অর্থাৎ লোকসাহিত্য যেন একটা বিরাট অরণ্য মহীরুহ—ইহার মূল অতীতের মধ্যে নিহিত, কিন্তু ইহার কাণ্ডের মধ্যে যে নিত্য নূতন শাখাপল্লব মঞ্জুরিত ফুলফল বিকশিত হইতেছে, তাহা বর্তমানের মধ্যে সমাহিত। লোক-সাহিত্যের কাল-নির্দেশ করিতে গিয়া আমাদের এই উক্তিটি একটু বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলেই চলিবে।লোক-সাহিত্য জনশ্রুতি (tradition)র উপর ভিত্তি করিয়া রচিত হয় ; কোন একটি বিষয় সম্পর্কে বিশেষ করিয়া একটি জনশ্রুতির উদ্ভব যে কখন হয়, ইতিহাস তাহার সন্ধান করিতে পারে না। রাজপুত্ৰ গোপীচন্দ্র ও রাজমাতা ময়নামতী সম্পর্কে সমাজের মধ্যে কখন কি অবস্থায় কে সর্বপ্রথম গীতিকা (ballad) রচনা করিয়া প্রচার করিয়াছিল, তাহা বলিতে পারা যাইবে না। তাহাঁদের সমসাময়িক কালে তাহাদের স্বাৰ্থত্যাগ ও অলৌকিক শক্তি সমাজকে প্রভাবান্বিত করিলেও এই বিষয়ক প্রথম গীতিকা-রচয়িতার আবির্ভাব আরও দুই শত বৎসর পরও যেমন হইতে পারে, তেমনই সমসাময়িক কালেও হইতে পারে। এই বিষয়ক প্রথম যাহা উদ্ভূত হইয়াছিল, তাহা গীতিকার কোন সুপরিণত রূপ নহে, বরং ইহার অন্তর্নিহিত ভাবটুকু মাত্র, অবশ্য সেই ভাব অপরিণত ও অপরিস্ফুট গীতিকা আশ্রয় করিয়াই আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। এই ভাব বা idea-টিকেই অরণ্য-মহীরুহের মূল (root) বলা হইয়াছে। মহীরুহ যেমন প্রতি বৎসরই নূতন শাখা প্রশাখার ভিতর দিয়া নবীন পত্রপুষ্প সৃষ্টি করিয়া বাহিরে নবকলেবর ধারণ করে, অথচ ইহার মৃত্তিকার অভ্যন্তরস্থ মূল (root) একই থাকিয়া যায়, লোক-সাহিত্যও তেমনই একই জনশ্রুতিমূলক পুরাতন ভাব ধারা অক্ষুণ্ণ রাখিয়া ক্রমপরিবর্তনের ভিতর দিয়া ইহার বহিরঙ্গে নব নব রূপ ধারণ করে। অতএব লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হইয়া ক্রমপরিবর্তন লোক-সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট ধর্ম—বৃক্ষের পক্ষে জীর্ণ পত্র পরিত্যাগ করিয়া মূল (root) অক্ষত রাখা যেমন ধর্ম, লোক-সাহিত্যের পক্ষেও মূল ভাবধারা অক্ষুণ্ণ রাখিয়া বহিরঙ্গগত ক্রমপরিবর্তন সাধন অবশ্য পালনীয় ধর্ম; কারণ, ইহারা উভয়ই সজীব এবং জীবনের ধর্মই পরিবর্তন—যাহা মৃত ও জড় তাহাই শুধু অপরিবর্তিত থাকিয়া যায়। উপরোক্ত উপমাটিকেই আর একটু সহজ করিয়া বলা হইয়াছে যে, ইহা 'always grafting the new on to the old.” অথ্যাৎ পুরাতনের মধ্য হইতে ইহাতে নূতনের জন্ম হইতেছে। লোক-সাহিত্যের কাল (age) সম্বন্ধে আলোচনা করিতে গিয়া আর একজন ইংরেজ সমালোচকও বলিয়াছিলেন ‘It has been carried down the centuries and like a snow-ball without losing its ancient core has gathered round it the spiritual and imaginative riches of a people of a much more advanced age, of a much more civilized culture.’ -- R. M. Dawkins, “The Meanings of Folktales. Folk-Lore, LXII (1951) p, 428 এই উক্তিটির মধ্যে পূর্বে যে কথাটি বলা হইয়াছে, সেই কথাটি সমর্থিত হইলেও ইহাতে একটি নূতন কথাও বলা আছে। নূতন কথাটির ভিতর দিয়া ইহার বহিরঙ্গগত পরিচয়ের মধ্যে আধুনিক সভ্য সমাজের যে কি দান আছে, তাহারই উল্লেখ করা হইয়াছে। ইহাতে দেখিতে পাওয়া যাইবে যে,প্রাচীন জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করিয়া লোক-সাহিত্যের উদ্ভব কিংবা ইহা এক স্বতন্ত্র ধারায় প্রবাহিত হইয়া থাকে বলিয়া মনে হইলেও, ইহার সঙ্গে আধুনিক চিন্তাধারার যে কোন যোগ নাই, তাহা নহে। অতএব লোক-সাহিত্য প্রাচীন হইয়াও নূতন, প্রাচীনের সহিত নূতনের যোগসূত্র রচনায় লোক-সাহিত্যই একমাত্র উপায়। ইহার মধ্যে প্রাণশক্তি আছে বলিয়াই ইহা অতীতের ভিতর দিয়া অগ্রসর হইয়া আসিয়া বর্তমান ক্ষেত্রেও উত্তীর্ণ হইয়া যাইতে পারে। প্রাচীন (classical) সাহিত্যের সঙ্গে লোক-সাহিত্যের এইখানেই পার্থক্য-যুগের সীমা অতিক্রম করিয়া আসিয়া প্রাচীন (classical) সাহিত্য অচল হইয়া পড়ে, ইহা আর রচিত হইতে পারে না ; কিন্তু লোক-সাহিত্য সক্রিয় প্রাণশক্তির অধিকারী বলিয়া অতীত হইতে বর্তমানে এবং বর্তমান হইতে ভবিষ্যতে সহজেই অগ্রসর হইয়া যাইতে পারে। উন্নততর সমাজ ও সমৃদ্ধতর সভ্যতার সংস্পর্শে আসিয়া ইহা নূতনতর রূপ লাভ করিলেও ইহার অন্তর্নিহিত পরিচয় অক্ষুন্নই থাকিয়া যায়। অতএব যাহাদের ধারণা নিরক্ষর পল্লীবাসীর সাহিত্যই লোক-সাহিত্য, উক্ত সংজ্ঞানুযায়ী তাহাদের কথা সমর্থিত হয় না। কেহ কেহ সেইজন্যই মনে করিয়াছেন, লোক-সাহিত্যের কাল (age) সম্পর্কিত প্রশ্ন যেমন অনাবশ্যক, তেমনই অপ্রাসঙ্গিক। লোক-সাহিত্যের রসগ্রাহীদের মনে ইহার রচয়িতার কিংবা ইহার উদ্ভব-কাল সম্পর্কিত কোন প্রশ্নই উদিত হয় না—কেবল মাত্র যে প্রশ্ন উদিত হয়, তাহা স্বতঃস্ফূর্তি (spontaneity) ও সৌন্দর্ষের (beauty); ইহা পাইলেই রসিক মন তৃপ্ত হইয়া যায়, এই সম্বন্ধে ইহার অতিরিক্ত আর কোন ঔৎসুক্য তাহার থাকে না।
পূর্বেই বলিয়াছি, লোক-সাহিত্য হইতে অনেকেই প্রাচীনতর যুগের সামাজিক তথ্য সংগ্ৰহ করিয়া থাকেন। উপরে লোক-সাহিত্যের যে বৈশিষ্ট্যের কথা আলোচনা করা হইল, তাহা হইতেই বুঝিতে পারা যাইবে যে, তাহা ভুল ; ইহাতে নিরবচ্ছিন্ন প্রাচীন তথ্য যেমন নাই, তেমনই ইহার মধ্যে প্রাচীন ভাষারও সন্ধান পাওয়া যায় না। কেন্দ্রগত ভাবটি অক্ষুণ্ণ রাখিয়া ইহার বহিরঙ্গগত তথ্য ও ভাষা সর্বদাই যুগোপযোগী করিয়া লওয়া হয় ; কারণ, প্রাচীনতর সামাজিক তথ্য সম্পর্কিত ঐতিহাসিক বোধ যেমন গ্রাম্য শ্ৰোতৃবর্গের থাকিবার কথা নহে, তেমনই ভাষা-সম্পর্কিত কোন দুর্বোধ্যতাও তাহাদের সহ্য করিবার কথা নহে। শ্রোতৃবর্গ ইহার পরিবেশটি সর্বদাই যেমন নিজেদের পরিবেশের অস্থায়ী পুনর্গঠন করিয়া লয়, তেমনই ইহার ভাষাও সর্বদা নিজেদের সহজবোধ্য করিয়া লইয়া থাকে। গোপীচন্দ্রের গান পাঠ করিয়া স্বৰ্গত দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় অনুমান করিয়াছেন য়ে, ‘রাজমাতা ময়নামতী স্বয়ং হাটবাজারে যাইতেন। গোবিন্দচন্দ্রের মহিষীরা কোন সামগ্রী কিনিতে হইলে নিজেরা দোকানে উপস্থিত হইতেন।’ কিন্তু উত্তর বঙ্গের পল্লীর কৃষক-কবি রাজমাতা ও রাজমহিষী বুঝিতে নিজেদেরই সমাজের অন্তর্ভুক্ত বিত্তশালিনী নারীর কথা মনে করিয়াছেন, গোবিন্দচন্দ্রের রাজপরিবারের কথা কল্পনাও করিতে পারেন নাই। উত্তর বঙ্গে ও বিহারের সর্বত্র বিত্তশালিনী কৃষক রমণীগণ হাটবাজারে গিয়া নিজেরাই ক্রয়-বিক্রয় করিয়া থাকেন, ইহার অতিরিক্ত আর কোনও তথ্য ইহাতে নাই। অতএব ইহা হইতে গোবিন্দচন্দ্রের রাজপরিবারের কথা কল্পনা করা অসঙ্গত হইবে।
এখানে একটি কথা অতি সহজেই বুঝিতে পারা যায় যে, প্রাচীন কিংবা ঐতিহাসিক কোন তথ্য দ্বারা লোক-সাহিত্যের শ্রোতৃবর্গের কোনই কৌতুহল নিবৃত্ত হইবার কারণ নাই। খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে রাজা গোবিন্দচন্দ্রের অন্তঃপুর-জীবন প্রকৃত কি আদর্শে যাপিত হইত, সেই তথ্য আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষিত ঐতিহাসিকদিগের কৌতুহল নিবৃত্ত করিতে সক্ষম হইলেও, পল্লীর লোক-গীতিকার শ্রোতৃবর্গের নিকট সম্পূর্ণ অর্থহীন। তাহারা গীতিকার মধ্যে নিজেদের জীবনের রূপ যদি না পাইত, তবে তাহা গ্রহণ করিত না। সাহিত্যের মধ্যে আমাদের নিজেদের জীবনের , পরিচয় সন্ধান করিয়া থাকি এবং সেই সন্ধান পাই বলিয়াই তাহা আমাদিগকে আনন্দ দান করে। লোক-সাহিত্যও ইহার ব্যতিক্রম নহে। উচ্চতর সাহিত্যের মধ্যে রোমান্স-বিলাসিতার যে স্থান আছে, লোক-সাহিত্যের মধ্যেও তাহা আছে—কেবল শিশুসাহিত্য বা রূপকথায় তাহার মাত্রাধিক্য দেখিতে পাওয়া যায় মাত্র। অতএব লোক-সাহিত্য সমসাময়িক সাহিত্য, ইহার মধ্য হইতে পুরাতত্ত্ববিদের কৌতুহল নিবৃত্তির কোন অবিমিশ্র উপকরণের সন্ধান পাওয়া যাইবে না।একজন ইংরেজ সমালোচক এই সম্পর্কে বলিয়াছেন, —In fact, however old these stories may be, not only is there no probability and certainly no evidence that they are anything like old enough for this, but the adaptibility they show will surely suggest that anything extremely primitive must have step by step been discarded as the story was handed down through subsequent centuries more and more out of sympathy with many things which by age would either have lost any appeal to later generations ; or even have become simply distasteful.” -- R, M, Dawkins, "Some Remarks on Greek Folktales', Folk-Lore, LIX ( 1948), p, 54
যে পারিপার্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করিয়া লোক-সাহিত্য প্রথম উদ্ভূত হইয়া থাকে, তাহা কালক্রমে অপরিচিত হইয়া যাইবার ফলে লোক-সাহিত্যের অনেক বিষয়েরই তাৎপর্য সহজে বুঝিতে পারা যায় না। সাধারণ শ্রোতার নিকট ইহাদের গূঢ় তাৎপর্য বুঝিবার কোন প্রয়োজনও হয় না ; ইহাদের মধ্য দিয়া যে রসের ব্যঞ্জনা প্রকাশ পায়, তাহাতেই শ্রোতৃবর্গের কৌতুহল নিবৃত্ত হয়। অর্থ প্রকাশের পরিবর্তে রস-সৃষ্টিই লোক-সাহিত্যের লক্ষ্য। সেইজন্য আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন বিষয় কিংবা চিত্রাংশ হইতে রস গ্রহণে কাহারও কোন বাধা হয় না। এই বিষয়ে এখানে একটি দৃষ্টান্ত দিলে আমার বক্তব্য বিষয়টি স্পষ্টতর হইবে। বাংলার একটি সুপরিচিত ছেলে খেলার ছড়া এই প্রকার—
আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম্ সাজে।
ঝাঁঝ কাঁসার মৃদঙ্গ বাজে॥
রবীন্দ্রনাথ তাহার ‘ছেলে ভুলানো ছড়া' নামক প্রসিদ্ধ প্রবন্ধে উল্লেখ .করিয়াছেন যে, ইহার প্রথম পদটির অর্থাৎ ‘আগডুম বাগডুম্ ঘোড়াডুম্ সাজে' ইহার কোনও অর্থ হয় না। রবীন্দ্রনাথের মত কবিও যে বাংলা ছড়ার কোন অর্থের সন্ধান পাইলেন না, তাহা যে খুব বেশি লোকের বোধগম্য হইয়াছে, তাহা মনে হয় না। অথচ ছড়াটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, যথার্থ অর্থ পরিগ্রহ না করিয়াও ইহার রস-গ্রহণে কোন বাধা হইতেছে না। ছড়াটির একটি সঙ্গত অর্থ সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বে আলোচনা করিয়াছি। তাহা হইতে বুঝিতে পারা যাইবে যে, ইহার পারিপার্থিক অবস্থা (situation) টি বর্তমান সমাজ হইতে লুপ্ত হইয়া যাইবার ফলেই ইহার অর্থ গ্রহণ করিতে আজ এত বেগ-পাইতে হইতেছে। ছড়াটি একটি ডোম চতুরঙ্গের বর্ণনা। ইহার প্রথম পদটির অর্থ আগডুম অর্থাৎ অগ্রবর্তী ডোম সৈন্যদল, বাগডুম্ অর্থাৎ পার্শ্ব (বাগ) রক্ষী ডোমসৈন্যদল ও ঘোড়াডুম্ অর্থাৎ অশ্বারোহী ডোমসৈন্যদল। যখন বাংলার পশ্চিম সীমান্ত রক্ষার জন্য বিষ্ণুপুর ও বীরভূমের রাজগণ ডোমসৈন্যদল নিযুক্ত রাখিতেন, তখন তাহাদের বীরত্বব্যঞ্জক এই চিত্রটি শিশুমন অধিকার করিয়াছিল। আজ বাংলার সীমান্ত রক্ষার প্রয়োজনীয়তা দূর হইয়া যাওয়ায় ডোমজাতি সমাজের অস্পৃশ্য আবর্জনা রূপে গণ্য হইতেছে; সেইজন্য একদিন যে তাহারাই বাংলার ধনমান রক্ষা করিত, সে কথাও আজ আমরা বিস্তৃত হইয়াছি।
রবীন্দ্রনাথ এই সম্পর্কে উল্লেখ করিয়াছেন, “শুনা যায় মঙ্গল ও বৃহস্পতির কক্ষমধ্যে কতকগুলি টুকরা গ্রহ আছে। কেহ কেহ বলেন, একখানা আস্ত গ্রহ ভাঙিয়া খণ্ড খণ্ড হইয়া গিয়াছে। এই ছড়াগুলিকেও সেইরূপ টুকরা জগৎ বলিয়া আমার মনে হয়। অনেক প্রাচীন ইতিহাস, প্রাচীন স্মৃতির চূর্ণ অংশ এই সকল ছড়ার মধ্যে বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে, কোনো পুরাতত্ত্ববিদ আর তাহাদিগকে জোড়া দিয়া এক করিতে পারেন না, কিন্তু আমাদের কল্পনা এই ভগ্নাবশেষগুলির মধ্যে সেই বিস্তৃত প্রাচীন জগতের একটি সুদূর অথচ নিকট পরিচয় লাভ করিতে চেষ্টা করে।’
সুতরাং দেখা যাইতেছে, লোক-সাহিত্যের মধ্যে অবিমিশ্র ঐতিহাসিক উপাদান লাভ করিবার উপায় নাই—বিশেষ একটি যুগ কিংবা বিশিষ্ট একটি সমাজের চিত্র ইহার ভিতর দিয়া প্রকাশ পায় না ; ইহার মধ্যে একাধারেই অতীত যুগের ঐতিহাসিক চিত্র যেমন প্রকাশ পাইতে পারে, তেমনই সমসাময়িক কালের নিতান্ত অর্বাচীন চিত্রও প্রকাশ পাইতে পারে—কিন্তু উভয়ই এখানে সমান অস্পষ্ট হইয়া পাশাপাশি অবস্থান করে। অস্পষ্টতাই যাহার ধর্ম, তাহার কোনও ঐতিহাসিক দাবী থাকিতে পারে না।
[গ্রন্থপঞ্জি: বাংলার লোকাসাহিত্য- খন্ড-১, আশুতোষ ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা নং-২৯-৩৪ ]
Post a Comment